বিবার্তা সম্মাননা পাচ্ছেন মোস্তাফা জব্বার

বিবার্তা সম্মাননা পাচ্ছেন মোস্তাফা জব্বার

প্রযুক্তিবিদ, উদ্যোক্তা, সংগঠক, লেখক-সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, মন্ত্রী… তার নামের সাথে এমন আরো অনেক তকমাই জুড়ে দেয়া যায়। তবে তাকে চেনার জন্য এসব কিছুরই প্রয়োজন নেই। শুধু নামটাই যথেষ্ট – মোস্তাফা জব্বার।
বিবার্তা সম্মাননা পাচ্ছেন মোস্তাফা জব্বারকেননা, এর সব ক’টা বাদ দিয়ে শুধু একটা অভিধাই তাকে বরণীয় ও স্মরণীয় করে রাখার জন্য যথেষ্ট। সেটা হলো মোস্তাফা জব্বার নামের এ মানুষটি বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্পে কম্পিউটার বিপ্লবের অগ্রদূত ও মহানায়ক। বিগত শতাব্দীর সেই ৮০-র দশকে, যখন কম্পিউটার নামের যন্ত্রটি এ দেশের মানুষের কাছে চাঁদের মতোই দূরের বস্তু, তখন এ মানুষটিই কম্পিউটারের সাহায্যে ডেস্কটপ পাবলিকেশনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, দেখিয়েছিলেন এবং সকল বাধাবিঘ্ন ও তুচ্ছতাচ্ছিল্যকে জয় করে সফলও হয়েছিলেন।

সেদিনের সেই সাফল্যের সুফল ভোগ করছে আজ সারা দেশ, গোটা জাতি। আজ যে প্রকাশনা মানেই কম্পিউটার এবং ঘরে-ঘরে কম্পিউটার – এর একক কৃতিত্ব যদি কোনো ব্যক্তিকে দিতে হয়, তবে সে ব্যক্তিটি অবিসংবাদিতভাবে মোস্তাফা জব্বার ছাড়া আর কেউ নন। অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিবার্তা২৪ডটনেট তাকেসম্মাননা জানাবে। আগামী ৬ মার্চ বিকালে জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে এই গুণীজনকে বিবার্তা স্বর্ণপদক দেয়া হবে।

এবারও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে মোট ১০টি ক্যাটাগরিতে ১০জনকে সম্মাননা দেয়া হবে। মোস্তাফা জব্বারের পৈতৃক নিবাস নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে। ১৯৪৯ সালের ১২ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার চর চারতলা গ্রামে নানাবাড়িতে তাঁর জন্ম। বাবা আব্দুল জব্বার তালুকদার পাটের ব্যবসায়ী ও সম্পন্ন কৃষক ছিলেন।

 

১৯৬০ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে তৎকালীন সিলেট জেলার (বর্তমান হবিগঞ্জ জেলা) আজমিরীগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত বিরাট নামক একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৬৬ সালে মানবিক শাখায় এসএসসি পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকা কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক সম্মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই পরীক্ষাটি ১৯৭১ সালে হবার কথা ছিলো। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পরীক্ষা হলেও মুক্তিযুদ্ধের কারণে পরে সেটি বাতিল হয়ে যায়। এরপর তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭২ সালের পরীক্ষা ১৯৭৪ সালে সম্পন্ন করে দ্বিতীয় শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

 

ছাত্রজীবনে মোস্তাফা জব্বার রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, সাহিত্য চর্চা, সাংবাদিকতা, নাট্য আন্দোলনের সাথে ব্যাপকভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তার লেখা বাংলাদেশের প্রথম গণনাট্য ‘এক নদী রক্ত’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে মঞ্চস্থ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠকালে তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অন্যতম নেতা ছিলেন। ১৯৭৩ সালে তিনি ছাত্রলীগের পক্ষে নির্বাচন করে সূর্যসেন হলের নাট্য ও প্রমোদ সম্পাদক নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার আগে তিনি সাপ্তাহিক ‘জনতা’ পত্রিকায় লেখালেখির সাথে যুক্ত ছিলেন।

 

১৯৭১ সালে মোস্তাফা জব্বার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি মুজিব বাহিনীর খালিয়াজুরি থানার সহ-অধিনায়ক ছিলেন। ছাত্র থাকাকালেই মোস্তাফা জব্বারের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৭২ সালের ১৬ জানুয়ারি সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে। সেই সময়ে তিনি সাপ্তাহিক (পরে দৈনিক) গণকণ্ঠ পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৩ সালে তিনি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক নির্বাচিত হন। গণকণ্ঠ বন্ধ হয়ে যাবার পর তিনি ট্রাভেল এজেন্সি, মুদ্রণালয়, সংবাদপত্র ইত্যাদি ব্যবসায় যুক্ত হন। তিনি ট্রাভেল এজেন্টদের সংগঠন আটাব (অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ)-এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
বিবার্তা সম্মাননা পাচ্ছেন মোস্তাফা জব্বার১৯৮৭ সালের ২৮ এপ্রিল মেকিনটোশ কম্পিউটারের বোতাম স্পর্শ করার মধ্য দিয়ে কম্পিউটার ব্যবসায় প্রবেশ করেন। সেই বছরের ১৬ মে তিনি কম্পিউটারে কম্পোজ করা বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা আনন্দপত্র প্রকাশ করেন। ১৯৮৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর তিনি প্রকাশ করেন বিজয় বাংলা কি-বোর্ড ও সফটওয়্যার। এটি প্রথমে মেকিন্টোশ কম্পিউটারের জন্য প্রণয়ন করা হয়। পরে ১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ তিনি উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের জন্যও বিজয় বাংলা কি-বোর্ড ও সফটওয়্যার প্রকাশ করেন।

 

মোস্তাফা জব্বার বাংলাদেশের সংবাদপত্র, প্রকাশনা ও মুদ্রণশিল্পে ডিটিপি বিপ্লবের অগ্রনায়ক। তিনি আনন্দ প্রিন্টার্স এবং আনন্দ মুদ্রায়ণের প্রতিষ্ঠাতা। তার হাতেই গড়ে ওঠে দেশের প্রথম ডিজিটাল বাংলা নিউজ সার্ভিস আনন্দপত্র বাংলা সংবাদ (আবাস)। তিনি এর চেয়ারম্যান ও সম্পাদক। তিনি আটাব-এর মহাসচিব, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির নির্বাহী পরিষদের সদস্য, কোষাধ্যক্ষ ও সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি ও পরিচালক এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। ২০০৮-০৯ সময়কালে তিনি দ্বিতীয় বারের মতো,২০১০-১১ সালে তৃতীয় বারের মতো এবং ২০১৪ পর্যন্ত চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

 

তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সসহ বিভিন্ন সংস্থায় যুক্ত আছেন। তিনি ২০১৪-১৬ সময়কালে বৃহত্তর ময়মনসিংহ সাংস্কৃতিক ফোরামের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। নেত্রকোণা জেলা সমিতিরও উপদেষ্টা তিনি। নেত্রকোণা যুব সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। দেশে কম্পিউটারের শুল্ক ও ভ্যাটমুক্ত আন্দোলন ও শিক্ষায় কম্পিউটার প্রচলনের জন্য মোস্তাফা জব্বার এখন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ক অনেক কমিটির সদস্য। তিনি কপিরাইট বোর্ড এবং বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক অথরিটির সদস্য।

 

২০০৭ সালের ২৬ মার্চ তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা সম্পর্কে প্রথম নিবন্ধ লেখেন এবং তার চেষ্টাতেই ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ”ডিজিটাল বাংলাদেশ” প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার লিপিবদ্ধ হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন এবং বাংলাদেশ সরকার এখন সেই প্রতিশ্রুতি বা ঘোষণা বাস্তবায়ন করছে।

 

মোস্তাফা জব্বার কম্পিউটার বিষয়ে অনেকগুলো বই লিখেছেন। দেশের কম্পিউটার বিষয়ক পত্রিকাসমূহে ব্যাপকভাবে লেখালেখি ছাড়াও নবম ও দশম শ্রেণীর কম্পিউটার বিষয়ক পাঠ্যপুস্তক ”মাধ্যমিক কম্পিউটার শিক্ষা” এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের “তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি” বইয়ের লেখক তিনি।এছাড়াও তার লেখা উচ্চ মাধ্যমিক কম্পিউটার শিক্ষা, প্রাথমিক কম্পিউটার শিক্ষা, মাল্টিমিডিয়া ও অন্যান্য প্রসঙ্গ ছাড়াও তার লেখা কম্পিউটারে প্রকাশনা, মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, মাইক্রোসফট এক্সেল ও তার সম্পাদিত কম্পিউটার অভিধান ব্যাপকভাবে প্রচলিত কম্পিউটার বিষয়ক বই।

 

মোস্তাফা জব্বারের প্রথম উপন্যাস নক্ষত্রের অঙ্গার ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়। সুবর্ণে শেকড় নামে আরেকটি উপন্যাস তিনি লিখছেন। এছাড়াও কম্পিউটার কথকতা, ডিজিটাল বাংলা, একুশ শতকের বাংলা, বাঙ্গালী ও বাংলাদেশ, ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং একাত্তর ও আমার যুদ্ধ তার লেখা বইগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘ব্যবসায় তথ্যপ্রযুক্তি’, ‘কম্পিউটার’ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ টক শো’র মাধ্যমে তিনি এখনও কম্পিউটার প্রযুক্তিকে জনপ্রিয় করে চলেছেন। এটিএন বাংলার ‘কম্পিউটার প্রযুক্তি’ এবং চ্যানেল আই’র ‘একুশ শতক’ অনুষ্ঠানের সহায়তায় ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমেও তিনি কম্পিউটারকে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে চলেছেন।

 

তথ্যপ্রযুক্তিতে বিশেষ অবদান রাখা এবং বিজয় বাংলা কিবোর্ড তৈরির জন্য দৈনিক উত্তরবাংলা পুরস্কার, পিআইবির সোহেল সামাদ পুরস্কার, সিটিআইটি আজীবন সম্মাননা ও আইটি অ্যাওয়ার্ড, বেসিস আজীবন সম্মাননা পুরস্কার, বেস্টওয়ে ভাষা-সংস্কৃতি পুরস্কার, বৃহত্তর ময়মনসিংহ সমন্বয় পরিষদ সম্মাননা, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটি ও সিলেট শাখার সম্মাননা বিশ্বমেধাসম্পদ সংস্থার আবিষ্কারক-উদ্যোক্তার স্বীকৃতি এবং অর্থনৈতিক ও মানবিক উন্নয়ন সংস্থার নেত্রকোণার গুনীজন সম্মাননা (প্রযুক্তিবিদ হিসেবে) এবং এসোসিও ৩০ বছর পূর্তি সম্মাননাসহ ২০টি পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এছাড়াও তার রয়েছে অসংখ্য শুভেচ্ছা সম্মাননা।

 

মোস্তাফা জব্বার তাঁর নিজ গ্রামে বাবার প্রতিষ্ঠিত হাইস্কুলের সম্প্রসারণ করেছেন, বাবা-মার নামে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং গ্রামের হাজী আলী আকবর পাবলিক ডিগ্রী কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে কম্পিউটার শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন ও কম্পিউটার সাক্ষরতা প্রসারে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করে চলেছেন। দেশজুড়ে মাল্টিমিডিয়া প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা ছাড়াও তিনি বিজয় ডিজিটাল স্কুল এবং আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুলের সাহায্যে শিক্ষাব্যবস্থার নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করেছেন।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment